ঘূর্ণিঝড় রেমালের কয়েক মাস পর ফের চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ডানা। সাতক্ষীরার উপকূলে আঘাত হানা প্রায় সবকয়টি ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করেছে উপকূলের মানুষের সহায়-সম্পদ। একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই উপকূলের দূর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। নদ-নদীর পানিতে প্লাবিত হয়ে সব কিছু হারিয়ে নিস্ব হয় নদীর পাড়ে বেড়িবাঁধ বা তার কাছাকাছি এলাকায় বসবাসকারি দরিদ্র অসহায় মানুষগুলো। ফলে ঝড়ের কথা শুনলেই আঁতকে উঠে উপকূলের মানুষ।
উপকূলে বসবাসকারি অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের মতই কোন ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই আঁতকে উঠেন নবিছা খাতুন। কারণ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামের সুন্দরবন সংলগ্ন মালঞ্চ নদীর পাড়ের বাসিন্দা নবিছা খাতুন ভিটা-মাটি সব হারিয়েছেন এই ঝড়েই। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ কেন্দ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আগাম আবহাওয়া বার্তা শুনে ফের দুশ্চিন্তায় কপালে ভাজ পড়েছে তার।
২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলায় ভিটা-মাটি, মৎস্য ঘের, ফসলি জমি সবকিছু হারিয়ে নিঃস হয়ে পড়া নবিজা খাতুন ১৫ বছরেও ভুলতে পারেননি সে কথা। নবিছা খাতুন বলেন, ‘ঝড়র কথা শুনিলেই প্রাণটা চমকে উঠে। না জানি আবার কি হয়ে যায়।’ ইতিমধ্যে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র পূর্বাভাসের কথা কানে পৌঁছেছে তার। তাই পূর্বের ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যাওয়া বাঁধের ওপর বসে কি যেন ভাবছিলেন তিনি।
নবিছা খাতুনের দুই ছেলে। স্বামী সন্তানদের নিয়ে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা ছোবল মারে তাদের সুখের সংসারে। এটাই শেষ নয়, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান তাদের অবশিষ্ট সম্পদ বিলীন করে দিয়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই আছে উপকূলে। এরই মধ্যে তিনি হারিয়েছেন স্বামীকে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে তার দুই সন্তান। বাপের পৈত্রিক সম্পত্তি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু স্বামীর শেষ সম্বল বসতভিটার মায়ায় এবং স্বামীর কবরের দিকে তাকিয়ে আজও সেখানে আছেন নবিছা খাতুন।
নবিছা খাতুন আইলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সেদিন সকাল থেকে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, হালকা বাতাস ছিল। প্রতিদিনের মতো বাড়ির কাজ করছিলাম। ঠিক দুপুরের আযানের একটু আগে হঠাৎ উঁচু পানির ঢেউ এসে লন্ডভন্ড করে দিল সব। সেদিন সেই পানির মধ্য থেকে কীভাবে যে বেঁচে গেছি, তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।
নবিছার মতোই ঝড়ের কথা শুনলে আঁতকে উঠেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসরত হাজারো পরিবার। দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তারা। দুর্বল বেড়িবাঁধ তাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ। দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লেই বারবার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় লোকালয়। লবণ পানি ঢুকে বিপর্যস্ত হয় জীবনযাত্রা। নষ্ট হয়ে যায় খাবার পানির উৎসসহ, সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড। এছাড়া উপকূলে বসবাসরত মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।
সম্প্রতি সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও আইলার অনেক বড় বড় ক্ষত এখনো দৃশ্যমান। এদিকে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন আন্দামান সাগর এলাকায় সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এটি ধীরে ধীরে আরও ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২৩ অক্টোবর শক্তি বাড়িয়ে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ তৈরি হবে এবং পরদিন ২৪ অক্টোবর সকালে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করবে।ভার তের আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ২৪ তারিখ উপকূলে হাওয়ার গতিবেগ থাকবে সম্ভাব্য ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। সেটা বেড়ে ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়ও হতে পারে। ফলে সমুদ্র থাকবে উত্তাল। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায়ও বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার।
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর, এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালে ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে অশনি এবং ২০২৩ সালের ১৪ মে ‘মোখা’ আঘাত হানে। সর্বশেষ সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এটি ২০২৪ সালের ২৬ মে সন্ধ্যা থেকে ২৭ মে সকাল নাগাদ স্থলভাগ অতিক্রম করে। এ সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন। যার ক্ষত শুকায়নি এখনো।
©খুলনার সময় ২০২৩ | এই ওয়েবসাইটের সকল লেখা, ছবি, ভিডিও সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত